ড. মুহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ্ মঈন,
ইলমে দ্বীনের জগতে এক উজ্জল নক্ষত্রের নাম মাওলানা মুহাম্মদ ফখরুদ্দীন। জ্ঞানের গভীরতায় ও অসাধারণ পান্ডিত্যে ভরপুর সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্থ এই ক্ষণজন্মা হাদীস বিশারদের সাথে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক একটি গৌরবের সোনালী অধ্যায়। পারিবারিক পরিমন্ডলে তাঁর পরিবারবর্গের সাথে মেলামেশা,আতিথেয়তা গ্রহণ ও তাঁদেরকে আমাদের পরিবারে মেহমান হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপনে তাঁর ইলমী পান্ডিত্যের কথা আশির দশকের শেষ প্রান্তে প্রথমে শুনতে পাই। মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার খ্যাতনামা একজন মুহাদ্দিস আমাদের আত্মীয় একথা ভাবতেই কেন জানি পুলকিত হয়ে উঠতাম। ১৯৯৩ সালে দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি লোহাগাড়ার অজপাড়া গাঁ থেকে
সরাসরি তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা, ঢাকায় আলিম শ্রেণিতে ভর্তি হই। জীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ চুকিয়ে সবেমাত্র তিলোত্তমা রাজধানী শহরে পদার্পন করে অজানা অচেনা পথের যাত্রায় মেস জীবনের নতুন অভিজ্ঞতায় প্রবেশ করলাম। নিজে থাকার মত করে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার পিছনে যিনি সময় ও মেধা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি হলেন বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শাযায়াত উল্লাহ ফারুকী। ধীরে ধীরে এই পরিচিত বলয় প্রসার লাভ করতে থাকে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থী কক্সবাজার নিবাসী হাফেজ কাজী মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান বেলালের অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও সহযোগিতা ছিল অবর্ণনীয়। সিনিয়র কৃতি শিক্ষার্থীদের সহচার্যের ঢাকা মহানগরীর অচেনা পরিবেশ নিজের কাছে আস্তে আস্তে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। এরই মাঝে সোয়া দুইশত বছরের ঐতিহ্যে সজ্জিত মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার মূল অবয়ব নিজ চোখে দেখার বাসনা মনের মাঝে উকি দিতে থাকে। যদিও বা তৎকালীন সময়ের ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ার ছাত্র সংগঠনের অযৌক্তিক ও অনাকাঙ্খিত পদচারণায় মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার ঐতিহ্য ফিতে হতে চলেছে। যুগে যুগে জগদ্বিখ্যাত যে সব ওলামায়ে কিরাম বখশী বাজারের এই দ্বীনি বাগিচাকে ফুলে ফলে সমৃদ্দ করেছিলেন তাদের প্রস্থানে বিশাল জ্ঞানের সাগরে ভাটা পড়তে লাগল। আমার আপন ফুফাতো ভাই, বড় ভাইতুল্য মাওলানা হাবিবুর রহমান, সাবেক সিনিয়র শিক্ষক, কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (আল্লামা ফখরুদ্দীন সাহেবের আপন ভায়রা) এর কাছে আলিয়া মাদরাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণের মধ্যে প্রোজ্জল একজন সম্পর্কে বিস্তরিত জেনে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। ১৯৯৫ সালে আলিম পরীক্ষা পরবর্তী সময়ে ফলাফল প্রত্যাশী ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু হিসেবে উপযুক্ত পরিবেশ বিবেচনায় ঢাকা আলিয়ার পরিচিতি একজন সিনিয়র ভাইয়ের মাধ্যমে আল্লামা কাশগরী (রাঃ) হলে অতিথি শিক্ষার্থী হিসেবে আবাসিক হলাম। ভারতীয় উপমহাদেশের উম্মুল মাদারেস খ্যাত মাদরাসা-ই-আলিয়ার জান্নাতী পরিবেশ কিভাবে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে চলে গেল তা স্বচক্ষে অবলোকন করলাম। কিছু ছাত্র নামধারী রাজনৈতিক লেবাসী হায়েনারা ইলমের মশালবাহী উস্তাদগণের জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেল। আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র না হয়েও অনেক অজানা তথ্য জানার সুযোগ আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার তৎকালীন ফকীহ হযরত মাওলানা ছাদেক হোছাইন, মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ওয়াজিহুদ্দীন, ভিন্ন মতাদর্শ ও চিন্তার অধিকারী মাওলানা আশরফ আলী, চট্টগ্রাম চন্দনাইশ নিবাসী সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা খাইরুল বশরসহ অনেক মুহাদ্দিসের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠল। বিশেষ করে মাওলানা খাইরুল বশর সাহেবের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা কখনো ভুলার মত নয়। এ সূত্র ধরে মাওলানা খাইরুল বশর ২০০০ সালে আমার গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে এসে আমাকে ধন্য করেছেন। প্রখ্যাত এই মুহাদ্দিসগণের সহচার্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানতম মাধ্যম ছিল, আমি ইলমে হাদীসের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র অধ্যাপক মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেবের আত্মীয় হই।
আল্লামা কাশগরী (রাহ:) হলের কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছে গল্পে গল্পে জানলাম একজন খুব ভালো মুহাদ্দিস অভিমান করে স্বইচ্ছায় বদলী নিয়ে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় চলে গেছেন। ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় হাদীসের দরস দেয়া একটি পরম সৌভাগ্য ও ঐতিহ্যের ব্যাপার হওয়া সত্বেও রহস্যজনক কারণে হাদীসের জীবন্ত একটি সনদ সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় প্রস্থান করলেন তা জানার আগ্রহ আমার মধ্যে দানা বাঁধল। যখন স্পষ্ট হলো যে তিনিই অধ্যাপক মাওলানা ফখরুদ্দীন, যার প্রস্থানে ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় বিশাল শূন্যতা চরমভাবে অনুভূত হচ্ছিল। অবৈধভাবে চর দখলের ন্যায় আল্লামা কাশগীর (রা:) হল দখলে নিয়ে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে মাদরাসার দ্বীনি পরিবেশকে তছনছ করে দিল। ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় স্থানান্তর হয়ে স্বগৌরবে অপরূপ মহিমায় ভাস্বর ছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সফরের সময় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মূল ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ঝরালাম। মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকার বর্তমান পরিবেশও এর ব্যক্তিক্রম নয়। অধ্যাপক মাওলানা ফখরুদ্দীন এর ঢাকা ত্যাগ আলিয়া মাদ্রাসার ঐতিহ্য হারানোর নিম্নগামীতাকে আরো ত্বরান্বিত করেছিল। আলিয়া মাদরাসার পতনোম্মুখ পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখে সহ্য করতে পারেননি অধ্যাপক মাওলানা ফখরুদ্দীন। মাদরাসার স্বর্গীয় দ্বীনি পরিবেশ যখন ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছিল তখন প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি নিরবে সিলেট আলিয়া মাদরাসায় যোগদান করেন। হাদীসের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ঈমাম বোখারী (রা.) যেমন নিজ এলাকা ত্যাগ করে সমরখন্দ হিজরত করেছিলেন, আল্লামা ফখরুদ্দীন (রা:) এর ঢাকা ত্যাগও এর সাথে তুলনীয়। ১৯৯৭ সালে আমি মাদরাসা-ই-আলিয়ায় কামিল হাদীস বিভাগে ভর্তি হই। তৎকালীন অনেক খ্যাতনামা মুহাদ্দিসগণের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হলেও যুগশ্রেষ্ঠ এই মুহাদ্দিসের হাদীসের সনদ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হই। আলিয়া মাদ্রাসার সকল ছাত্র ও শিক্ষকগণের কাছে আল্লামা ফখরুদ্দীন (রা:) ছিলেন নক্ষত্রতুল্য একজন হাদীস বিশারদ ও তুলনাহীন ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের সকল বিখ্যাত আলিয়া মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কৃতি শিক্ষার্থীর পদাচারণা এখনো বিদ্যমান। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার আল-কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও ইসলামী জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ স্কলারগণের সান্নিধ্যে আসার সুবাধে আল্লামা ফখরুদ্দীন (রা:) কে জানার আরো সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাঁর ইলমের গভীরতা, হাদীস শাস্ত্রের উপর তাঁর অগাধ পান্ডিত্য, আরবী ভাষাবিদ হিসেবে সুখ্যাতি আমার শিক্ষকগণের কাছ থেকে আরো বেশি করে জানতে পারি। আলিয়া মাদরাসার সাবেক কৃতি শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন তাদের মুখে এই জগদ্বিখ্যাত হাদীস বিশারদের কথা প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হত। ইলমে হাদীসের নির্ভরযোগ্য ও যথাযথ একটি সনদের প্রস্থানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা অপূরণীয়। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি ইলমে হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণের পর দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় তিনি আমৃত্যু শায়খুল হাদীস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আত্মীয়তার সূত্রে তাঁর গ্রামের বাড়ীতে অনেকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আতিথেয়তা, আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণতায় ভরপুর ছিল তাঁর দরদমাখা হৃদয়। ইলমে হাদীসের মশাল প্রজ্জলনকারী এই ক্ষণজন্মা মনীষির সালাতুল জানাযা ছিল আলেম ওলামা ও দ্বীনি কাননের কান্ডারীগণের মিলন মেলা। আল্লাহ তা’আলা জান্নাতের উচ্চতর মাকামে তাঁকে মেহমানের আসনে আসীন করুন। আমীন।
লেখক:
প্রভাষক, চট্টগ্রাম সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ