তিনদিনের মিউনিখ শান্তি সম্মেলন শেষে আজ সোমবার সকালে দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সম্মেলনটি ছিল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকার গঠনের পর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর উষ্ণ অভিনন্দন পাওয়া এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বর্তমান বিশ্বের কাছে শান্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়া বড় একটি অর্জন।
এ ছাড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের মাধ্যমে সম্মেলন কূটনীতিকে কাজে লাগাতে পারার বিষয়টি নতুন সরকারকে অনেক স্বস্তি দিয়েছে। এ ছাড়া সম্মেলনের বাইরে সাইডলাইনের বৈঠকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রকল্পে ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার পাশাপাশি বাজেট সহায়তায় ৫ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। শান্তি সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের কাছে ছয়টি পরামর্শ বা দফা প্রস্তাব তুলে ধরার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নজর কেড়েছেন। যখন পরাশক্তিগুলো অস্ত্রের সরবরাহের মাধ্যমে চলমান যুদ্ধগুলোকে উস্কে দিচ্ছে সেখানে যুদ্ধের পরিবর্তে জলবায়ু তহবিলে অর্থ বরাদ্দের আহ্বান জানানোর কারণে শেখ হাসিনা প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রশংসা পেয়েছেন। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সত্ত্বেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শেখ হাসিনার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে শেখ হাসিনা যুদ্ধে অংশ নেওয়া সবপক্ষকেই অস্ত্র ছেড়ে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। সব মিলে সরকারপ্রধানের চলতি মেয়াদে প্রথম সফরে আশানুরূপ প্রাপ্তি হয়েছে। কূটনীতিক বিশ্লেষকদের মতে, নতুন সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনার মিউনিখ সম্মেলনটি বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বিশেষ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা সম্মেলনের মূল আকর্ষণে পরিণত হয়েছেন। মিউনিখ যাওয়ার পর মূল সম্মেলন ও সম্মেলনের বাইরে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। এ ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার ছয়টি প্রস্তাবই মূল আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। একইসঙ্গে যুদ্ধ এবং জলবায়ু তহবিলে সহায়তা বাড়ানোর প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দফাতে রয়েছে, সংবেদনহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করা এবং তার পরিবর্তে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয় করা। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো যে অঙ্গীকার করেছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দুই বছরে বার্ষিক ১ হাজার কোটি ডলারের বা ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আমাদের অবশ্যই ২০২৫-পরবর্তী নতুন জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রার ব্যাপারে একমত হতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড থেকে সরে আসতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগ প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য যে অর্থায়ন করা হয় তাতে প্রচণ্ড ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। অভিযোজন অর্থায়নের বর্তমান হারকে অন্তত দ্বিগুণ করতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাবে রয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল পাওয়ার পথ সুগম করার দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধান করা। পঞ্চম পরামর্শে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক অর্থায়নে সংস্কার করা।
বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঋণের বোঝা ব্যবস্থাপনায় অনুদান ও ঋণের ছাড়ে সুযোগ বাড়ানো। শেখ হাসিনার সর্বশেষ পরামর্শে রয়েছে, জলবায়ু কর্মের জন্য ব্যক্তিগত পুঁজি প্রবাহকে একত্রিত করতে সরকারগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ এবং উপকরণে বিনিয়োগের পরামর্শ দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, মিউনিখ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যাপক আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। তারা তাকে (প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ায়) অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং তিনি (শেখ হাসিনা) এমএসসি-২০২৪-এর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, সাইডলাইনের বৈঠকের ফলে বিশ্ব ব্যাংক চলমান ৫৬টি প্রকল্পে ১৬শ’ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা (ডলার ১১০ টাকা হিসেবে) এবং ৫০ কোটি ৯০ লাখ ডলার বা ৫ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বাজেট সহায়তার প্রতিশ্রুতি ছাড়াও সম্প্রতি রোহিঙ্গা ও দরিদ্র মানুষের জন্য ৭০ কোটি ডলার বা ৭ হাজার ৭শ কোটি টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত বাজেটে সহায়তা দিতে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংককে ধন্যবাদও জানান প্রধানমন্ত্রী। মিউনিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল-থানি। এর আগে সকালে উইমেন পলিটিক্যাল লিডারসের (ডব্লিউপিএল) সভাপতি সিলভানা কোচ- মেহরিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে তারা পারস্পরিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর আহ্বান জানান। মিউনিখ সফরে শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের জন্য দুইপক্ষকেই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। জানা গেছে, সম্মেলনের সাইডলাইনে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন এবং কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল-থানির সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা ফিলিস্তিন ও রোহিঙ্গা সমস্যার পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয়েও আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক (ডিজি) তেদ্রস আধানম গেব্রিয়াসুসের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া মেটা গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী স্যার নিক ক্লেগ এবং বিশ্ব ব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট পলিসি অ্যান্ড পার্টনারশিপের সিনিয়র ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গের সঙ্গেও বৈঠক করেন। এ ছাড়া নিরাপত্তা সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বিশ্ব ব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট পলিসি অ্যান্ড পার্টনারশিপের সিনিয়র ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, নতুন সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনার প্রথম সফরটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে কূটনীতিক সফলতা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অর্জনও রয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরিম-লে রোহিঙ্গা ইস্যুটি উত্থাপনের প্রয়োজন ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপযুক্ত ফোরামেই রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে যুদ্ধ বন্ধের জন্য উভয়পক্ষকেই ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর প্রস্তাবও বর্তমান সময়ের জন্য ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এক কথায় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বিদেশ সফর সফল হয়েছে।
১২ ঘন্টা ৩ মিনিট আগে
১২ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আগে
১ দিন ২০ ঘন্টা ৪৭ মিনিট আগে
২ দিন ১২ ঘন্টা ৩১ মিনিট আগে
৫ দিন ২১ ঘন্টা ৫৮ মিনিট আগে
৮ দিন ৮ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে
৯ দিন ৭ ঘন্টা ২৯ মিনিট আগে
৯ দিন ১৬ ঘন্টা ৩৯ মিনিট আগে