সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী গুড়পুকুরের মেলা জেলা প্রশাসন ও সাতক্ষীরা পৌরসভার আয়োজনে ১৫ দিন ব্যাপী শুরু হয়েছে।
তথ্যানুস্ধানে জানা যায়,গুড়পুকুরের মেলা বা গুড়পুকুর মেলা, বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা, যার বয়স প্রায় ৩০০ বছর বলে অনুমিত হয়। সাধারণত পলাশপোল স্কুলের মাঠ আর পলাশপোল গ্রামই ছিলো মেলার মূল কেন্দ্রস্থল।লৌকিক আচার-আচরণ, বিশ্বাস আর পৌরাণিকতায় সমৃদ্ধ সাতক্ষীরা। বছরের প্রায় প্রতিটি সময় ধরে অগণিত মেলা বসে সাতক্ষীরায়। সাগরদ্বীপ দুবলোর চরের মেলা থেকে শুরু করে খুলনা, যশোর এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত। এ জেলার শুধু নয় দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মেলাটি বসে সাতক্ষীরা শহরেই, পলাশপোলে, গুড়পুকুরের পারে। গুড়পুকুরের নামানুসারেই মেলার নামকরণ করা হয়েছে গুড়পুকুরের মেলা।
মেলাটির উৎপত্তি সম্পর্কে সোবাহান খান চৌধুরীর (৮০) বক্তব্য এরকম, ‘অনেক পথ হেঁটেছেন, আজ ক্লান্তিতে পা আর উঠতে চায় না। শেষ ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে মিইয়ে এসেছে সমস্ত শরীর। ওই যে গৌরদের পুকুরপারের বটগাছটা ওর ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেয়া যাক। বটের ছায়ায় বসতে না বসতেই ঘুম এসে গেল ফাজেলের, শেকড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। গাছতলার ঘুম।
গাছতলার রোদের মতই ছেঁড়া ফাটা নড়বড়ে। বটের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তীব্র রশ্মি এসে পড়লো ফাজেলের মুখে। ঘুম ভেঙে যেতে লাগলো, অস্বস্তিবোধ করলেন তিনি।
মগডালে বসেছিল এক পদ্মগোখরো সাপ। সে তা লক্ষ্য করলো এবং নেমে এলো নিচে, যে পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে ফাজেলের মুখে পড়েছে ঠিক সেখানে। ফণা তুলে দাঁড়ালো সাপটা। ফণার ছায়া এসে পড়লো ফাজেলের মুখে। তিনি আরাম পেয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লেন।
কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার পর আবার ঘুম ভেঙে গেলো। এর মধ্যে ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেছে। বটের পাতায় পাতায় দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন সেই সাপটিকে। তখনও সে ফণা তুলে সূর্যকে আঁড়াল করে আছে। এবার ফণাটা একটু দুলে উঠলো, দুলে উঠলো গাছের পাতারা।
ফণা নামিয়ে সাপটি হারিয়ে গেল ডালে ডালে। আবার সূর্যরশ্মি এসে পড়লো ফাজেলের মুখে। তখন তার চোখে ঘুমের রেশমাত্র নেই। শরীরে নেই একবিন্দু ক্লান্তি।
ফাজেল বটতলা ত্যাগ করলেন এবং এলাকার হিন্দুদের ডেকে বললেন, ‘এখানে তোমরা মনসা পূজা কর।’সেদিন ছিল ভাদ্র মাসের শেষদিন। বাংলা ১২ শতকের গোড়ার দিকের কোন এক বছর। তখন থেকে গুড়পুকুরের দক্ষিণ পারের এই বটতলাতেই শুরু হয় মনসা পূজা। আর পূজা উপলক্ষে মেলা।
এখন প্রশ্ন হলো সোবাহান খান চৌধুরীর পূর্বপুরুষ ফাজেল খান চৌধুরীর আসল পরিচয় কি?সে আরও অনেক দিন আগের কথা। তখন বাংলাদেশে সুলতানী শাসন চলছে। বাংলার সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নতুন ধারার সূত্রপাত হয়েছে। ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব.
মুসলমান সমর নায়ক ও সৈনিকদের সাথে সাথে এদেশে প্রবেশ করতে শুরু করেছে সাধারণ কর্মচারী, ব্যবসায়ী, ভাগ্যান্বেষী ও সুফী দরবেশ। পীর দরবেশরা এদেশে এসে ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করলেন। সে সময় আরও অনেকের মত এলেন খানজাহান আলীও।
বাংলা ৯ম শতকে তিনি বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। যা প্রাক মুঘল স্থাপত্যের এক অতুলনীয় নিদর্শন হিসেবে আজও বিদ্যমান। খানজাহান আলী যখন ষাটগম্বুজ মসজিদে অবস্থান নিয়ে ধর্ম প্রচার করতে থাকেন তখন তার দু’জন ব্রাহ্মণ খাজাঞ্চি ছিল। একজনের নাম কামদেব রায় চৌধুরী, জয়দেব রায় চৌধুরী অন্যজন।
একদা খানজাহান আলী রোজা থাকা অবস্থায় একটা কমলালেবুর ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন, তখন ব্রাহ্মণদ্বয় বললেন, হুজুর আপনিতো আজ রোজা আছেন। এ অবস্থায় কমলার ঘ্রাণ নিলেন, ঘ্রাণে অর্ধভোজন নয় কি? খানজাহান আলী মৃদু হাসলেন, বললেন, তোমাদের সন্দেহ ঠিকই, আমার রোজার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। অন্য আর একদিন খানজাহান আলী নিজেই রান্না করছিলেন।
ব্রাহ্মণদ্বয় সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে পড়লেন। তারা বললেন, হুজুর আপনি নিশ্চয় মাংস রান্না করছেন, বড়ই সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। খানজাহান আলী আবারও মৃদু হাসলেন এবং বললেন, ব্রাহ্মণ মশাইরা তোমরা তো গরুর মাংসের ঘ্রাণ নিয়ে ফেলেছো, এখন ব্রাহ্মণত্বের কি হবে?কামদেব ও জয়দেব চিন্তায় পড়লেন এবং কয়েকদিন পর খানজাহান আলীর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। কামদেবের নাম হলো কামালউদ্দিন খান চৌধুরী আর জয়দেবের জামালউদ্দিন খান চৌধুরী। উল্লেখ্য, এই কামদেব ও জয়দেবের কথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাসে বর্ণনা করা হয়েছে। এ দু’জনের মধ্যে কোন একজনের পরবর্তী বংশধর বুড়া খাঁ। বুড়া খাঁ বাগেরহাট থেকে এসে সাতক্ষীরার প্রাণকেন্দ্র পলাশপোলে বাড়িঘর তৈরি করেন। গড়ে তোলেন পলাশপোল চৌধুরী বাড়ী। চৌধুরী বাড়ীর পূর্বপার্শ্বে একটি দরগা তৈরি করে সেখানে ধর্ম সাধনা করতে থাকেন। দরগাটি বিরাট এক বটগাছ কাঁধে করে এখনও টিকে আছে। বুড়া খাঁ তার বংশধরদের রেখে যান পলাশপোল চৌধুরী বাড়ীতে। চৌধুরী বাড়ীর অধীনে তখন পলাশপোল মৌজার বৃহৎ এলাকা। এলাকাবাসী খাজনা দিতো চৌধুরীদের। বর্তমানে সাতক্ষীরা পৌরসভার সবচেয়ে বড় ৯নং ওয়ার্ডই পলাশপোল। সেই বাংলা বারো শতকের কোন এক সময় বুড়া খাঁর বংশধর ফাজেল খান চৌধুরী পলাশপোল এলাকায় খাজনা আদায় করে ফিরছিলেন। সেদিন ছিলো ভাদ্র মাসের শেষ দিন। অর্থাৎ ৩১ তারিখ। পলাশপোল গুড়পুকুর পাড়ের বটতলায় বসেন বিশ্রাম নিতে আর তখনই ঘটে উপরে বর্ণিত ঘটনাটি। সেই থেকে শুরু হল পূজা ও পূজা উপলক্ষে মেলা। কেউ বলেন, মনসার সাথে ওখানে বিশ্বকর্মারও পূজা হয়ে থাকে।
মেলার নাম গুড়পুকুর আর পুকুরের নাম গুড়। এই নামের জট এখনও খোলেনি। কিভাবে হলো এ নামকরণ- কেউ বলেন, মনসা পূজার সময় পুকুরে বাতাসা ফেলা হতো। ওই বাতাসার জন্যে পুকুরের পানি মিষ্টি লাগতো। তখন থেকেই গুড়পুকুর।
অনেকের ধারণা পুকুরে পানি থাকতো না বেশিদিন। স্বপ্ন দর্শনে জানা গেলো একশ’ ভাঁড় গুড় ঢালতে হবে পুকুরে। স্বপ্ন নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা হলো। সেই যে পুকুরে পানি এলো আর শুকালো না। আবার শোনা যায় পুকুরের তলদেশ থেকে এক সময় মিষ্টি পানি উঠতো তাই এর নাম গুড়পুকুর হয়েছে।
একজন বললেন, পুকুরের জায়গাতে অসংখ্য খেজুর গাছ ছিল এবং প্রচুর রস হতো ওই গাছে। একবার গাছের সমস্ত রস দিয়ে গুড় তৈরি করে তা’ বিক্রি করা হলো এবং ওই বিক্রিত টাকা দিয়ে পুকুরটি কাটা হলো। তখন থেকে গুড়পুকুর।
আবদুস সোবাহান খান চৌধুরী বলেছেন, আসলে ওসব কিছু নয়। চৌধুরীপাড়ার রায় চৌধুরীরা গৌর বর্ণের ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাই তাদের পুকুরকে বলা হতো গৌরদের পুকুর। কালক্রমে হয়েছে গুড়পুকুর।
পুকুর সংলগ্ন বসবাসকারী নিতাই কর্মকার (৭৫) ও সোবাহান খান চৌধুরীর বিবরণের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন।সেদিনের গুড়পুকুরের মেলা আজ অনেক বড় হয়ে উঠেছে। মেলানুষ্ঠানের পাঁচ/ছয় মাস আগে থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে সাজসাজ রব পড়ে যায়। বিশেষ করে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরার কলম-চারা ব্যবসায়ী ও কাঠমিস্ত্রি বা ফার্নিচারের কারখানাগুলোতে কাজের তোড়ে ঘুম বিদায় নেয়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও এর প্রভাব পড়ে।
ঢাকা, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্টেশনারি দোকানদাররা আসে। মূল মেলা ৩১শে ভাদ্র হলেও আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি অব্দি মেলার বেচাকেনা চলে। লাখ লাখ মানুষের সমাগমে ভরপুর হয়ে ওঠে মেলা। গাছের চারা-কলম ও ফার্নিচার ছাড়াও শিশুদের বিভিন্ন খেলনা, আখ, লেবু, ঝুড়ি, ধামা, কুলা, টুকরি, বাটি, দেলকো, শাবল, খোন্তা, দা, ছুরি, কোঁদাল প্রভৃতি বিক্রি হয়ে থাকে। কাঠ ও বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র ছাড়াও বেতের ও মাটির তৈরি নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র সুলভে পাওয়া যায়। মেলাতে এসে বাতাবী লেবু ও ইলিশ মাছ না কিনে কেউ বাড়ী ফিরত না। সার্কাস, যাত্রা, পুতুল নাচ, মটর সাইকেল, মৃত্যু কূপ, চরকি, নাগরদোলা, মিষ্টি পান মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল। খুলনা রোড থেকে তুফান কোম্পানীর মোড়, আর নিউ মার্কেট থেকে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্ক পর্যন্ত মেলা বিস্তৃত থাকলেও পলাশপোল স্কুলের মাঠ ও পলাশপোল গ্রামই মেলার কেন্দ্রস্থল। গত কয়েক বছর ধরে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা মেলার সার্বিক তত্ত্বাবধান করে আসছে। মাঝে চাঁদা আদায়কারীদের অত্যাচারে অনেক ব্যবসায়ীর মেলা ছাড়বার উপক্রম হয়েছিল।
২০০২ সালে সার্কাস পার্টিতে বোমা হামলার পর মেলাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী মেলাটি আবারও শুরু হয়েছ
৫ ঘন্টা ৪৫ মিনিট আগে
৩ দিন ৮ ঘন্টা ৪৯ মিনিট আগে
৪ দিন ৭ ঘন্টা ৫৩ মিনিট আগে
৪ দিন ১০ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আগে
৬ দিন ৮ ঘন্টা ৪০ মিনিট আগে
৬ দিন ১১ ঘন্টা ৫৫ মিনিট আগে
৬ দিন ১২ ঘন্টা ২৩ মিনিট আগে
৮ দিন ৭ ঘন্টা ৪৫ মিনিট আগে