অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুসের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪তম মহান বিজয় দিবস উদযাপনে অংশ নিতে গত ১৪ ডিসেম্বর শনিবার ঢাকায় এসেছিলেন পূর্ব তিমুরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তা৷ সিঙ্গাপুরের একটা বিশেষ এয়ারলাইনসে তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত হন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও তার অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টাগণ। সেখান থেকে পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তা বঙ্গভবনে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে সৌজন্যে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জানান, পূর্ব তিমুরের কোনো প্রেসিডেন্টের এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। এই সময় রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন দুইদেশের মধ্যে পারস্পারিক আন্তঃসম্পর্ক জোরদার হবে বলে মনে করেন। রাষ্ট্রপতি জানান পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতার পর স্বীকৃতি দানকারী প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল অন্যতম। বাংলাদেশে পূর্ব তিমুরের অনারারি কনস্যুলেট প্রতিষ্ঠায় স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন- বাংলাদেশে অনেক দক্ষ চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবি, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় পারদর্শী কর্মক্ষম জনশক্তি রয়েছে যাদেরকে পূর্ব তিমুর প্রজাতন্ত্র নিজ দেশে বিনিয়োগ করে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে তরান্বিত করতে পারে। উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দুই দেশকে এগিয়ে নিতে আধুনিক সমরাস্ত্র, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষার নতুন নতুন ক্ষেত্রে উভয়ের বিনিয়োগ ও পারস্পরিক সম্পর্কের বিকল্প নেই। গত ১৬ই ডিসেম্বর রবিবার পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের সাথে মহান বিজয় দিবসের পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ র্যালিতে অংশ নেওয়া শেষে বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে। নোবেলজয়ী এই দুই নেতার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার অংশ ছিল অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়। উভয় নেতার ওই যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিমুর-লিস্তের রাষ্ট্রপ্রধান জোসে রামোস হোর্তা বাংলাদেশের মতো তার দেশের জনগনের ভোগান্তি ও অস্থিরতাসহ তার নেতৃত্বে আসার ইতিহাস তুলে ধরেন, বর্ণনা করেন যেভাবে দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরেছে তার আদ্যোপান্ত। উভয় নেতা দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্কের অসারতা ও সম্ভাবনাসহ বিশ্বব্যাপি মানবিক সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরবর্তী ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত এসব বিষয়ের তাৎপর্য তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনুস তিমুর-লিস্তের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রশংসা করে বলেন, বিশ্বাঙ্গণে প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তা একজন মানবিক নেতা ও মহান লেখক। প্রধান উপদেষ্টা দুদেশের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা, বিমান পরিসেবা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জ্বালানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোতে পারস্পরিক সহযোগিতা কামনা করেন। চারদিনে ঢাকা সফরে আসা এই প্রেসিডেন্ট উভয় দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহলকে পূর্ব তিমুরে বিনিয়োগ করতে উদাত্ত আহ্বান জানান। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যম কর্মীদের ১৯৯৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই রাষ্ট্রনায়ক জোসে রামোস হোর্তা বলেন, আমি মনে করি আমরা বাংলাদেশ থেকে এখন থেকে আরো পণ্য আমদানি করতে পারবো এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ব তিমুরে কাজ করার আমন্ত্রণ জানায়। তিনি আরো বলেন, আমরা আগামী বছর আসিয়ানের সদস্য হবো এবং পূর্ব তিমুর চার ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অঞ্চলে পরিনত হবে। এছাড়াও দেশটি ৭০০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর অঞ্চলের অংশ হয়ে উঠবে। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অংশ হয়ে তিনি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনে আসিয়ানের যথার্থ সমর্থন আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দেন। এদিকে গনঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ইউনুস গনমাধ্যমকে জানান, যখন তিনি প্রথমবার পূর্ব তিমুর সফর করেছিলেন তখন তিনি দেখেন সেখানকার দোকানগুলোতে বাংলাদেশীদের ব্যবহৃত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো বিক্রি হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলেন, তিনি জোসে রামোস হোর্তার ঔদার্যতা দেখে রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন যখন তিনি তার নোবেল জয়ের সমস্ত টাকা ক্ষুদ্র ঋণে দান করেছিলেন। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি বিগত সরকারের দুর্বৃত্তায়নে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো নাজুক অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। পতিত সরকার থাকাকালীন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের সামগ্রীক বাজেট নির্ধারণ করা হয় প্রায় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ২৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ২৮ লাখ কোটি টাকা বিভিন্নভাবে পাচার হয়েছে যা দেশের তিনটি বাজেটের সমপরিমাণ। এদিকে সম্প্রীতি ভারতের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ছাত্রজনতার এই সরকার সার্কসহ আসিয়ানভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর সাথে বন্ধুসুলভ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কি ভূমিকা রাখবে তাই এখন দেখার বিষয় সবার৷
লেখকঃ মোঃ আসিফ আহমেদ
(শিক্ষার্থী)
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
যোগাযোগঃ mdasifahmed672@gmail.com