অস্ত্র-সরঞ্জাম ও অর্থযোগান দিয়ে সোনাদিয়ার আত্মস্বীকৃত দস্যু সুমন মিয়া ৭ এপ্রিল ১২-১৩ জনের একটি গ্রুপকে সাগরে ডাকাতির উদ্দেশ্যে পাঠায়। এতে নেতৃত্ব দেন শামসুল আলম মাঝি। সাগরে নামার আগে দল ভারী করতে শামসু ও নুরুল কবিরের মাধ্যমে পাঁচ উঠতি তরুণকে প্রলোভনে ফেলে ‘ভাড়াটে ডাকাত’ হিসেবে সাগরে নামান। আর কূলে বসে সব নির্দেশনা দেন সুমন। তিনি সাগরে যেতেন না। কিন্তু মাছসহ ডাকাতির মালামাল বিক্রির অর্থের বড় অংশ বাগিয়ে নিতেন।
পুলিশের গভীর তদন্ত, আসামিদের জবানবন্দি ও একাধিক সুত্রে পাওয়া তথ্যে ট্রলার থেকে ১০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার ঘটনার বিস্তারিত উঠে এসেছে। তদন্তে হত্যাকান্ডে জড়িত ২৫ জেলের সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছে। পুলিশ এ মামলার তদন্ত গুছিয়ে এনেছে । শীঘ্রই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক (গোয়েন্দা) দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, ‘সাগরে ঘটে যাওয়া হামলার ঘটনায় ২৫ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। তদন্তে উঠে আসা নামগুলো যাছাই করা হচ্ছে। যাদের সংশ্লিষ্টতা মিলবে তারাই আইনের আওতায় আসবে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, গত ৯ এপ্রিল একটি গ্রুপ সাগরে সংঘবদ্ধ ডাকাতির সংঘটিত করে। এতে দু-পক্ষের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ডাকাতি করতে যাওয়া গ্রুপটির গুলি শেষ হয়ে গেলে এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ জেলেরা দুটি ট্রলার নিয়ে জড়ো হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেন। ১২-১৩ জনের ওই গ্রুপটিকে পিটিয়ে হত্যার পর হাত-পা বেঁধে তাদের ট্রলারটি ডুবিয়ে দেয়।
পুলিশের ভাষ্য মতে, আত্মস্বীকৃত দস্যু সুমন মিয়া ১২-১৩ জনের ওই গ্রুপকে সাগরে পাঠানোর নাটেরগুরু। তবে সুমন এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
এ মামলার চার আসামির দুজন গ্রেপ্তার হলেও বাকী দুজন পলাতক। এখনো একটি ট্রলারের হদিস মেলেনি । নিখোঁজ ওই ট্রলারের মালিক কে? কারা ছিলেন? কতজন ছিলেন? সেই রহস্যও উন্মোচন হয়নি।
তদন্ত কর্মকর্তা দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, ‘সংঘবদ্ধ জেলেদের হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত দুটি ট্রলারের মধ্যে একটির সন্ধান মেলেনি। সুমনসহ বাকী আসামিরা গ্রেপ্তার হলে মূল রহস্য উদঘাটন হবে।’
জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্ত, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে অনেক তথ্য আমরা পেয়েছি। পুরো গ্রুপকে শনাক্ত করেছি। তদন্তও শেষ পর্যায়ে। অচিরেই চার্জশিট দেওয়া হবে।’
পুলিশের তথ্যমতে, এই হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যার মধ্যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবাবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মামলার প্রধান আসামি বাইট্টা কামাল, বাঁশখালীর বাসিন্দা ফজল কাদের মাঝি ও আবু তৈয়ুব মাঝি, মহেশখালী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খায়ের হোসেন, চকরিয়ার বদরখালী এলাকার মো. নুর নবীর ছেলে গিয়াস উদ্দিন মুনির, মাতারবাড়ি ইউনিয়নের সাইরার ডেইল এলাকার এস্তেফাজুল হকের ছেলে দেলোয়ার হোসেন। এর মধ্যে মামলার ৪ নম্বর আসামি করিম সিকদার ও বাইট্টা কামালের ভাই ইমাম হোসেন জবানবন্দি প্রদান করেননি।
কে এই নাটের গুরু সুমন?
আইনশৃংখলা বাহিনীর তথ্যমতে, এককালে কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতার নিয়ন্ত্রণ করতেন মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু আবদুল গফুর প্রকাশ নাগু মেম্বার।২০১৬ সালের ৪ জুলাই বিরোধের জেরধরে নাগুকে হত্যা করেন তার ভাই বাহাদুরের ছেলে সরওয়ার প্রকাশ বতৈল্যার নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী।
নাগুর মৃত্যুর পর সেখানে প্রভাব বাড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক তালিকাভুক্ত শীর্ষ দস্যু মোকাররম হোসেন জাম্বুর। সেসময় একের এক পর ডাকাতি করে সাগরে রামরাজত্ব চলায় জাম্বু। তবে ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর জাম্বু র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এ ঘটনায় ৪৪টি অস্ত্র ও ১ হাজার ২১৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র্যাবব।
আইনশৃঙ্খলা ও স্থানীয়দের মতে, জাম্বু অধ্যায়ের পর বাহিনীটির নিয়ন্ত্রণ নেন তার সহযোগী আনজু মিয়া। আনজু ছিলেন নাগুর ভাগ্নে। আর আনজুর মামাতো ভাই সুমন মিয়া। সুমন ছিলেন আনজুর বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। এই দস্যু গ্রুপটি সোনাদিয়া সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরকে অনিরাপদ করে জেলেদের মূর্তিমান আতংক ছিল।
তবে বছরখানেক পর এই বাহিনীর প্রধান আনজু ও সেকেন্ড ইন কমান্ড সুমনসহ নয় সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমপণ করেন। বছর-দেড়েক কারাভোগ শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন তারা।
জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অন্যান্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও সুমন ছিল ব্যতিক্রম। চিংড়ি ঘের ও কাঁকড়া চাষের আড়ালে পুনরায় অপরাধ জগতে পা বাড়ান তিনি। দস্যুতার পাশাপাশি মাঝি-মাল্লাদের অপহরণ করে বিভিন্ন সময় মুক্তিপণ আদায় করার ঘটনাও ঘটিয়েছে।
স্থানীয় সুত্রগুলো বলছে, সুমন মিয়া সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্ব পাড়ার মৃত মোস্তফার ছেলে। বিয়ে করেছেন বদরখালী থেকে। সেই সুবাদে শাপলাপুর আর চকরিয়ার কোনাখালীসহ উপকূলীয় অঞ্চলের অপরাধীদের সাথে তার সখ্যতা ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনাদিয়া দ্বীপের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে সুমনকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। যদিও পুলিশ বলছে, সুমনকে গ্রেপ্তারে তারা চেষ্টা চালাচ্ছে।
ন্যায় বিচার চায় বাদী রোকেয়া :
গত ২৩ এপ্রিল ১০ মরদেহ উদ্ধারের দুদিন পর ২৫ এপ্রিল ট্রলারের মালিক শামসুল আলমের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ করে অচেনা আরও ৫০-৬০ জনের নামে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন। ইতিমধ্যে এ মামলার দুই আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকী দুজন পলাতক। এজাহারে তিনি চারটি ট্রলারের জেলেরা হামলা করেছে মর্মে উল্লেখ করেন।
বাদী রোকেয়া আকতার বলেন, ‘ঘটনার পর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল। বর্তমানে কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। দুই আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। চারটি ট্রলারকে জব্দ করতে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু সেগুলো আজ অবদি জব্দ হয়নি। আমি নারী, যেটুকু পারি ন্যায় বিচার পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
যদিও পুলিশের তদন্তে দুটি ট্রলার ব্যবহারের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা দুর্জয় বিশ্বাস জানান।
উল্লেখ, গত ২৩ এপ্রিল নাজিরারটেক পয়েন্ট থেকে ভাসমান ট্রলারের ভেতর থেকে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরদিন ছয়জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। বাকি চার মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিলো। একই সঙ্গে নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। গত ৯ জুলাই ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার পর ৩ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলে মরদেহ ৪টি এদের কারও ছিলো না। এখনও চারজন নিখোঁজ।
তদন্ত কর্মকর্তা দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, ‘ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল হাতে আসার পর এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ট্রলারটিতে ঘটনার দিন মোট ১৩ জন ছিলেন। এ ঘটনার দু’দিন পর সোনাদিয়ায় একটি কঙ্কাল ভেসে আসে। আমরা ধারণা করছি, ওই কঙ্কালটি ট্রলারে থাকা কোনো ব্যক্তির।’
২ দিন ৮ ঘন্টা ৩০ মিনিট আগে
১৯ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট আগে
২৮ দিন ৮ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
৩০ দিন ৮ ঘন্টা ২৭ মিনিট আগে
৩৪ দিন ১০ ঘন্টা ৪৭ মিনিট আগে
৩৪ দিন ১০ ঘন্টা ৫০ মিনিট আগে
৪৯ দিন ২১ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আগে
৫২ দিন ৯ ঘন্টা ২৭ মিনিট আগে