পর্যটন শহর কক্সবাজারে রেল আসার কথা আগামী সেপ্টেম্বরে। কিন্তু গত সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নির্মাণাধীন রেললাইনের একটি অংশে পাথর ও মাটি ভেসে গেছে। রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে গেছে। এতে নির্ধারিত সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
চকরিয়া,সাতকানিয়া এলাকায় বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে এ অবস্থা হয়েছে। টানা অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বিভিন্ন এলাকা গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে ডুবতে শুরু করে। মঙ্গলবার ভোরে রেললাইন পানিতে তলিয়ে যায়। পরদিন বুধবার পানি নামে। এরপর রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে যাওয়া এবং লাইন থেকে পাথর ও মাটি সরে যাওয়া দৃশ্যমান হয়। এ পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত রেলপথ নির্মাণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী। তাঁরা বলছেন, ছোট ছোট যে কালভার্ট রাখা হয়েছে, সেগুলো পানিনিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট নয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপাত্ত অনুযায়ী, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলতি মাসে ৫৩০ থেকে ৫৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা।কিন্তু কক্সবাজারে রেকর্ড হয়েছে ৩১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত,বান্দরবানে ৭২ ঘণ্টায় (৫ থেকে ৭ আগস্ট) বৃষ্টি হয়েছে ৭৩৭ মিলিমিটার এবং চট্টগ্রামে একই সময়ে রেকর্ড ৫২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। কম সময়ে অধিক পরিমাণ বৃষ্টি ধারণ করতে পারেনি বলেই উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ডুবে গেছে চকরিয়া,ঈদগাঁও,রামু,সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশসহ ভাটি অঞ্চলের এলাকাগুলো।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর আগে ১৯৮০, ১৯৯৭ ও ২০১৯ সালেও এসব এলাকায় বন্যা হয়েছিল। তবে এবারের বন্যা সবচেয়ে ভয়াবহ হয়েছে। তবে গত বুধবার থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে অঞ্চলে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখান দিয়ে বান্দরবানের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। রেললাইন নির্মাণের সময় তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল। এখন রেললাইন করার কারণে পানিনিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে বন্যার ব্যাপকতা বেড়েছে। মানুষকে যেমন ভুগতে হচ্ছে, তেমনি রেলের সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
শুক্রবারও রেললাইনের দুই পাশের এলাকা ও বিলে পানি জমে ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের এলাকায় এমন ভয়াবহ বন্যা হয়নি। রেললাইনের কারণে পানিনিষ্কাশনের পথ আটকে যাওয়ায় তাঁদের এলাকার বাড়িঘর ডুবে গেছে। যদি রেললাইনে পর্যাপ্ত কালভার্ট বা সেতু নির্মাণ করা হতো, তাহলে এত ক্ষতি হতো না।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন পরিদর্শন করেন। তাঁদের মতে, এক কিলোমিটারজুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করা যাবে। তাই নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চালু নিয়ে সমস্যা হবে না। বন্যার পানিতে রেললাইনের এ অবস্থার কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং তা সংস্কারে কত অর্থ ব্যয় হবে, তা এখনো পরিমাপ করা হয়নি বলে জানান তাঁরা। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ। ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৮৮ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন বাকি আছে ১২ কিলোমিটার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ এম শামসুল হক বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ছোট ছোট কালভার্ট রাখা হয়েছে। কিন্তু তা পানিনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এই অঞ্চল দিয়ে পাহাড়ি এলাকার ঢল দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। পানিনিষ্কাশনের পথে রেললাইনের মাধ্যমে বাঁধ দেওয়ায় পানি নামতে পারেনি। যেহেতু রেললাইন হয়ে গেছে, তাতে সংশোধনের তেমন কোনো সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন এ ধরনের বৃষ্টি আরও হবে। তখন রেললাইন আবার ডুববে। এতে স্বাভাবিকভাবই মানুষ প্রশ্ন তুলবেন রেলওয়ে পরিকল্পিতভাবে রেললাইন নির্মাণ করেনি।
রেলওয়ের প্রকল্প–সংক্রান্ত নথি অনুসারে, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। মিয়ানমার সম্মত নয় বলে কক্সবাজার থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার অংশের কাজ আপাতত হচ্ছে না। প্রথমে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমা ঠিক করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। পরে দুই বছর সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
গত শুক্রবার সকালে কেঁওচিয়ার তেমুহনী এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, এই এলাকায় অন্তত চারটি স্থানে রেললাইন দেবে গেছে। কোথাও কোথাও এক–দেড় ফুট পর্যন্ত নিচে দেবে গেছে। নিচ থেকে পাথর ও মাটি সরে গিয়ে শূন্যে ভাসছিল রেললাইনের স্লিপারগুলো। গর্ত হয়ে যাওয়া অংশে পানি জমে ছিল। আবার কিছু অংশে রেললাইন ঠিক থাকলেও নিচে পাথর ছিল না।আর রেললাইনের দুই পাশ গতকালও পানিতে ডুবে ছিল।
অপরিকল্পিত রেলপথের কারণে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে—এলাকাবাসীর এই বক্তব্য মানতে নারাজ রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা। প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ১০০ বছরের বন্যার বিষয়টিও হিসাবে রাখা হয়েছিল। যে অংশে রেললাইন ডুবেছে, সেখানে প্রায় ২০ ফুট উঁচুতে লাইন করা হয়। এবার অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে রেললাইন ডুবে গেছে। আর ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মাত্র এক কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে রেললাইন চালু হওয়ার সম্ভাব্য সময়। এর আগেই সংস্কারকাজ শেষ করতে হবে। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন ঠিক করতে অন্তত পাঁচ শ থেকে এক হাজার বাড়তি জনবল যুক্ত করতে হবে।
২ দিন ৮ ঘন্টা ৩০ মিনিট আগে
১৯ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট আগে
২৮ দিন ৮ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
৩০ দিন ৮ ঘন্টা ২৭ মিনিট আগে
৩৪ দিন ১০ ঘন্টা ৪৭ মিনিট আগে
৩৪ দিন ১০ ঘন্টা ৫০ মিনিট আগে
৪৯ দিন ২১ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আগে
৫২ দিন ৯ ঘন্টা ২৭ মিনিট আগে