বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে বিভিন্ন গাছপালা, ফল ভেষজ উদ্ভিদের দেখা মেলে যেগুলো প্রকৃতির একেকটি বিস্ময়। এসবের অনেকগুলো আমাদের চোখের সামনে থাকলেও আমরা জানি না তাদের প্রকৃত উপকারিতা বা মূল্য। এমনই এক বিস্ময়কর ফল হলো পটকা ফল-যা বহু গ্রামীণ এলাকায় চেনা হলেও আজও থেকে গেছে প্রকৃতির এক অবহেলিত রত্ন হিসেবে। এই ফলের সৌন্দর্য, স্বাদ ঔষধি গুণাবলি একে করে তুলেছে বিশেষ। অথচ অজ্ঞতা অবহেলায় এই ফল আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।

পটকা ফল মূলত একটি বন্যফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম Sterculia foetida এটি একধরনের মাঝারি আকারের গাছ, যার উৎপত্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে। আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেট মধুপুরের কিছু এলাকায় এই গাছ স্বাভাবিকভাবে জন্মে। ফলটি আকারে মাঝারি, রঙে সবুজ থেকে পাকলে লালচে বা বাদামি হয়। পাকা অবস্থায় ফলটি ফেটে যায় এবং ভেতরে থাকা কালো চকচকে বীজগুলো বেরিয়ে আসে। এই বীজগুলোইপটকা বীজনামে পরিচিত, যেগুলো খাওয়ার যোগ্য এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর। পুষ্টি উপকারিতা হিসেবে পটকা বীজে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন ফ্যাটি অ্যাসিড এগুলো শরীরের কোষ গঠনে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলের ভেতরের তেল থেকে তৈরি হয় স্টেরকুলিয়া অয়েল, যা প্রাচীনকাল থেকে ত্বকের যত্ন, চুল পড়া রোধ এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রামীণ চিকিৎসকরা এই তেল ব্যবহার করেন সন্ধি ব্যথা, বাত চর্মরোগে এছাড়া শুকনো বীজ ভেজে খেলে এটি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং শরীরে শক্তি জোগায় আবার, ফলের শাঁস খোসা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যা কৃষক সমাজের জন্য এক প্রাকৃতিক সম্পদ।

ঔষধি গুণে ভরপুর পটকা গাছের প্রতিটি অংশেই রয়েছে ভেষজ গুণ। এর পাতা বাকল ব্যবহার করা হয় জ্বর, ডায়রিয়া ত্বকের প্রদাহে গাছের রস শরীর ঠান্ডা রাখে এবং রক্ত পরিষ্কার করে। বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা শরীরের ক্ষতিকর টক্সিন বের করে দেয়।বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এই ফলের নির্যাস ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এই গাছের বীজকে বলা হয়জীবনীশক্তি উদ্দীপক

পরিবেশ জীববৈচিত্র্যের মাঝেও ভূমিকা রাখে পটকা গাছ। শুধু ফলের জন্য নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি একটি দ্রুতবর্ধনশীল বৃক্ষ, যার শিকড় মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায়। গাছ পাখি ছোট প্রাণীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।বিশেষ করে পাকা ফল ফেটে গেলে যেভাবে এর বীজ ছড়িয়ে পড়ে, তা প্রাকৃতিক পুনর্জন্ম প্রক্রিয়ার জন্য অসাধারণ এক উদাহরণ।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মূল্যবান গাছ ফল আজ মানুষের অবহেলায় প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। বনভূমি ধ্বংস, রাসায়নিক দূষণ নগরায়নের চাপে পটকা গাছের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলেও এখন এই ফল চোখে পড়ে না। অনেকে একেঅখাদ্যভেবে গাছ কেটে ফেলছে। অথচ একটু সচেতনতা পরিচর্যা দিলে এই গাছ হতে পারে আয়ের এক বড় উৎস। বিশেষ করে এর তেল বীজ আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে

প্রকৃতির এই অনন্য উপহারকে টিকিয়ে রাখতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া প্রয়োজন। স্কুল-কলেজেস্থানীয় ফল বৃক্ষ রক্ষা অভিযানচালু করলে নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে জানতে পারবে। গবেষকরা যদি পটকা ফলের তেল, বীজ পাতা নিয়ে আধুনিক গবেষণা করেন, তবে এটি হতে পারে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় হারবাল শিল্পের কাঁচামাল

পটকা ফলকোনো সাধারণ বন্যফল নয়; এটি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। এর প্রতিটি অংশে রয়েছে ঔষধি গুণ, পুষ্টি পরিবেশগত উপকারিতা। অথচ অবহেলা অজ্ঞতার কারণে আমরা হারাতে বসেছি এই অনন্য সম্পদটি। প্রকৃতিকে ভালোবাসা মানে শুধু বড় বড় গাছ লাগানো নয়, বরং ছোট ছোট বুনোফল গাছপালাকেও যত্নে রাখা। আমাদের উচিত এখনই উদ্যোগ নেওয়া-পটকা ফল বাঁচাও, প্রকৃতি বাঁচাও এই স্লোগানকে সামনে রেখে। কারণ, প্রকৃতির এই অবহেলিত রত্ন একদিন হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষারই এক মূল্যবান সহচর।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024