|
Date: 2025-06-19 08:03:57 |
একসময় বর্ষার আগমনী বার্তা যেন বাতাসেই ভেসে বেড়াত। আষাঢ়ের মেঘ, কুজন করা কাক, গাছের পাতায় পাতায় ঝিরঝিরে বাতাসের খেলা—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশ ছড়িয়ে দিত বর্ষার পূর্ব মুহূর্তগুলো। শিশু থেকে বৃদ্ধ, শহর থেকে গ্রাম—সবার মনে এক অনির্বচনীয় রোমাঞ্চ ছড়িয়ে দিত এই সময়টি। কিন্তু সময় বদলেছে। প্রকৃতি বদলে গেছে। আর সেই বদলের প্রভাব পড়েছে আমাদের বর্ষার আগের সেই চিরচেনা মাধুর্যেও।
এখন বর্ষা আসে হঠাৎ করে। না থাকে আগের মতো হালকা বৃষ্টি, না থাকে মেঘের নাটকীয়তা। একসময় আকাশে দিগন্তজুড়ে দেখা যেত সাদা-কালো মেঘের লুকোচুরি খেলা, হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে দিত, আর শিশুদের মধ্যে তৈরি হতো আনন্দময় ভীতি। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই একঝাঁক বৃষ্টি নামে, বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, তারপর আবার হঠাৎ থেমে যায়। প্রকৃতির সেই স্নিগ্ধ অনুপম দৃশ্য যেন কোথাও হারিয়ে গেছে।
গ্রামে আগে বর্ষার আগে শুরু হতো মাঠে ধান রোপণের প্রস্তুতি, কৃষকের মুখে হাসি ফুটত। তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে হিসেব করত, কবে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। ছোট নদীগুলোতে পানি বাড়তে শুরু করত, কচুরিপানা ভেসে বেড়াত, আর জলে দেখা যেত মাছেদের লাফঝাঁপ। কিন্তু এখন নদীগুলো শুকনো, মাটির চিড় ধরে গেছে। খাল-বিল হয়ে গেছে আবর্জনার ভাগাড়। আর যেসব জায়গায় পানি আসে, সেগুলোতে দেখা যায় মাত্রাতিরিক্ত বন্যা বা জলাবদ্ধতা।
শহরে আগে বর্ষার আগমন মানে ছিল নতুন জামাকাপড় কেনা, ছাতা খোঁজা, মেঘলা দিনে ভাজা-পোড়া খাওয়ার আনন্দ। কলেজ-স্কুলে বন্ধুরা মিলে হঠাৎ ভিজে যাওয়ার স্মৃতি আজও অনেকের মনে গেঁথে আছে। এখন সেই রোমাঞ্চ ও কোথায় যেন ফিকে হয়ে গেছে। মানুষ ব্যস্ত, ক্লান্ত, আর বর্ষার কথা ভাবলেই কেবল মনে পড়ে যানজট, ড্রেন উপচে পড়া নোংরা পানি, আর রাস্তায় হাঁটার দুর্ভোগ।
প্রকৃতি আজ তার নিয়মিত তাল হারিয়ে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুগুলোর গড়পড়তা সময়চক্র নষ্ট হয়ে গেছে। গ্রীষ্ম দীর্ঘতর হয়েছে, বর্ষা এসেছে দেরিতে বা একসঙ্গে অতিরিক্ত বৃষ্টি নিয়ে। শহরায়ন ও বৃক্ষনিধনও এর জন্য দায়ী। গাছপালা কমে যাওয়ার ফলে মাটি তার আর্দ্রতা হারিয়েছে, বাতাসে নেই সেই স্নিগ্ধতা। ফলে বর্ষার আগমনের পূর্ব মুহূর্ত আর আগের মতো অনুভবযোগ্য নয়।
বর্ষার আগের এই হারিয়ে যাওয়া মাধুর্য শুধু প্রকৃতির ক্ষয় নয়, এটি আমাদের শৈশব, আমাদের অনুভূতির ক্ষয়। এক সময় যেসব স্মৃতি মন ছুঁয়ে যেত, আজ সেগুলোর অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ। তাই এখনই সময় প্রকৃতির প্রতি সচেতন হওয়ার। পরিবেশ রক্ষা, বৃক্ষরোপণ, জলাভূমি সংরক্ষণ—এইসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবার ফিরে পাবে বর্ষার সেই চিরন্তন রূপ।
বর্ষার আগমন যেন আবার হয়ে উঠুক চেনা ঘ্রাণ, মেঘের ডাক, আর শিশিরভেজা মাটির সৌরভে ভরা। সেই হারিয়ে যাওয়া মাধুর্যকে ফিরিয়ে আনতে চাই প্রকৃতির সাথে সহমর্মিতা—নয়তো একদিন বর্ষা থাকবে কেবল স্মৃতির পাতায়।
লেখক: অমিতাভ হালদার, শিক্ষার্থী, এমবিবিএস, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল, বাংলাদেশ ৷
© Deshchitro 2024