স্বৈরাচার কখনো নিজে নিজে স্বৈরাচার হয় না বা এক-দুই দিনেও হয় না। লিবিয়ার গাদ্দাফি, মিশরের হুসনি মুবারক কিংবা বাংলাদেশের সদ্য বিতাড়িত শেখ হাসিনা। সকল স্বৈরশাসকই অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গ, বিদেশি পরাশক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেন এবং ধীরে ধীরে স্বৈরশাসকের জন্ম হয়। তেমনই একটা উপাদান "Deep State" কিংবা রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্র। 


ডিপ স্টেট কয়েক ধরণের হতে পারে৷ কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ক্ষমতায় এসে সে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে দেখা যায় সরকার সবসময় স্বাধীন ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এক ধরনের গোপন গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে যারা সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এ সকল গোষ্ঠীগুলোকেই ডিপ স্টেট বলা হয়। মূলত, বেশিরভাগ স্বৈরশাসকই ক্ষমতায় বসার পর নিজ উদ্যোগে ডিপ স্টেট গঠন করে। সামরিক বাহিনীর সদস্য, গোয়েন্দা সংস্থা, কূটনৈতিক, আমলা, ব্যবসায়ীদের ভেতরে ডিপ স্টেট তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে কাজ শুরু করে৷ যেমন - পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসতে হলে সেনাবাহিনীর পরোক্ষ সমর্থন প্রয়োজন। বাংলাদেশে স্বৈরশাসকের সবথেকে বড় উদাহরণ “শেখ হাসিনা”। তিনি তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে “ডিপ স্টেট” তৈরি করেন। যাদের আমরা বলতে পারি স্বৈরশাসকের “খুটি”। এগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, সামরিক জেনারেল ও বেসামরিক সচিবদের নেতৃত্বাধীন সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী—কমিশনভোগী, ইন্ডেন্টর, বড় ব্যবসায়ী, চোরাচালানি, মালিক মহাজন দালাল এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িকসহ সব প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তিসমূহ। 


মূলত রাষ্ট্রের এ সকল বিভাগই তাদের নিজ নিজ জায়গা হতে গোষ্ঠী তৈরি করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে প্রায় ১৫ বছর যাবত কাজ করে গেছে। গোষ্ঠীসমূহ যেকোন কিছুর মূল্যে হলেও তারা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সবসময় কাজ করতো। বিনিময়ে তারা নিজ স্বার্থ অর্জন করতো কিংবা বিশেষ উপহার পেতো৷ উক্ত উপহারই তাদেরকে স্বৈরাচারী করে তোলে। উদাহরণস্বরুপ, আমরা দেখতে পাই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন আমলাগণ, ব্যবসায়ী, সামরিক বাহিনীর সদস্য, গোয়েন্দা সদস্য বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক। মূলত প্রত্যেকেই নিজ নিজ সেক্টরে “ডিপ স্টেট” তথা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গোষ্ঠী তৈরি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো। 


স্বৈরশাসকের একদল গোষ্ঠী সমূহ যখন দূর্বল হয়ে যায় তখন স্বৈরশাসক তার ক্ষমতা হারায়। উদাহরণস্বরুপ, কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের ডাকের কারণ হিসেবে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীদের বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্তকে দায়ী মনে করেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ। তাদের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের ফলে দেশে গণহত্যা শুরু করে সামরিক বাহিনীর বর্তমান ও সাবেকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। একই সাথে আমলা, ব্যবসায়ী সহ প্রায় সকল গোষ্ঠীর মধ্যে অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা দেয়। ফলস্বরূপ, ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন ও রক্তের পর শেখ হাসিনা তার ডিপ স্টেট এর কতৃত্ব হারিয়ে ফেলে। 


সুতরাং, ডিপ স্টেট বা রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র একজন ক্ষমতাসীন দলের প্রধানকে স্বৈরশাসক করে তুলতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। যখন সরকার তাদের ডিপ স্টেটের সাহায্য হারিয়ে ফেলে তখন তাদের পতন সুনিশ্চিত হয়ে যায়। শেখ হাসিনাও তার শেষ সময় অব্দি তার বানানো সকল গোষ্ঠীর প্রধানের কাছে সাহায্য আবেদন করেছিলো। তবে তিনি সফল হন নি এবং তার পতন হয়েছে। গত একশ বছরের ইতিহাসে পৃথিবীর বহু দেশ বহু স্বৈরশাসক দেখেছে । সকল নিন্দিত স্বৈরাচারই নিজের আত্মমহিমায় মগ্ন ছিলো। স্বৈরাচার শেখ হাসিনাও তার ব্যতিক্রম নন। তার শাসন রাষ্ট্রের সকল প্রকার উপাদানে- অর্থনীতি,  রাজনীতি,  সমাজ, সামরিক বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংস্কৃতি সর্বত্র তার আগ্রাসী মনোভাব চলমান ছিলো। 

স্বৈরশাসকরা তাদের স্বার্থ অর্জন করতে ডিপ স্টেট তৈরি করে। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আর কোন স্বৈরশাসক না চাইলে রাষ্ট্রের এ সকল সেক্টর বা গোষ্ঠীর প্রধান এবং পরিচালনাকারীদের সচেষ্ট থাকতে হবে৷



রাকিব হাসান 

বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ঢাকা কলেজ শাখা।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024