|
Date: 2022-10-19 17:21:37 |
সাতক্ষীরার উপকূলবাসী আগের দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠাতে না উঠতে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বঙ্গোপসাগরে বৃহস্পতিবারের মধ্যে লঘুচাপ সৃষ্টির বার্তা দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস। আবার এ লঘুচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ারও আশঙ্কা করছে তারা। যার নাম হতে পারে ‘সিত্রাং’। দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে প্রতিনিয়ত।
ষাটের দশকে নির্মাণ করা এখানকার বেড়িবাঁধগুলো আর পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা। জিও ব্যাগের বালুর বস্তা আর রিং বাঁধ দিয়ে কোনোরকম টিকিয়ে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ। এছাড়া বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। সে সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে। সবশেষ ২০২০ সালের ২০ মে বিকেলে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে সাতক্ষীরা উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এ সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। যার ক্ষত শুকায়নি এখনো।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের শেষ জনপদ সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন। সুন্দরবনের কুল ঘেঁষা এই দীপ ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে খোলপেটুয়া নদীর তীরে বেড়িবাঁধে বসবাস করেন সেলিনা বেগম বলেন, ‘২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর নদীতে বিলীন হয়ে যায় আমাদের ভিটামাটি। স্থায়ী মেরামত না হওয়ায় এখনো সেখানে জোয়ার ভাটা চলছে। তখন থেকে আমরা বেড়িবাঁধের পাশে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানেও শান্তিতে নেই। গেলো কয়েক বছরে ফণী, বুলবুল, আম্পানসহ একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশ্রয়স্থলটি। শুনলাম আবার নতুন ঝড় আসবে এতে আবারও ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কায় আছি।’
গাবুরা ইউনিয়নের ৯ নম্বর সোরা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল ওহাবের জমি নেই। নদীর পাশে সরকারি খাস জমিতে বসবাস তার। তিনি বলেন, ‘ঝড় এলেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা। ঘরবাড়ি ফেলে রেখে সাইক্লোন শেল্টারে যেতে হয়। আমাদের বাড়ি থেকে সাইক্লোন শেল্টারের দূরত্ব প্রায় ৫ কি.মি.। তারপরও জীবন বাঁচাতে সবকিছু ফেলে রেখে কষ্ট করে আমরা সেখানে যায়।’
একই গ্রামের বাসিন্দা হাসিনা বেগম বলেন, ‘ঝড় এলেই সবাই সাইক্লোন শেল্টারে যেতে বলে। কিন্তু বাড়িতে হাস, মুরগি, গরু, ছাগল ফেলে রেখে যেতে পারি না। অনেক সময় জীবন বাজি রেখে বাধ্য হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকতে হয় ‘
গাবুরার চিংড়ি চাষি শহিদুল আলম বলেন, ‘গতবার আম্পানের সময় আমার প্রায় ২০বিঘা জমির মাছের ঘের নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। সেবার অনেক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারিনি। আবার শুনছি নতুন করে ঝড় আসবে। এবার বাঁধ ভাঙলে একেবারে পথে বসতে হবে।’
গাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ২০০৯ সালে আইলা ও সবশেষ ২০২০ সালে আম্পানের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এখনো আমাদের ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের আটটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। জোয়ারের পানি বাড়লেই বাঁধ ভেঙে আবারো প্লাবিত হবে বিস্তীর্ণ এলাকা। এর আগে বার বার বাঁধ ভাঙলেও টিকে থাকার স্বার্থে মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে রিং-বাঁধ দিয়ে পানি বন্ধ করে। তবে এখনো স্থায়ী বাঁধ হয়নি। এখন ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এর খবরে নতুন করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এখানকার মানুষ ।’ সেলিনার মতো অনেকই আতঙ্কে দিন পার করছে বেড়িবাধের পাশে বসবাসরত হাজারো মানুষ। দূর্বল বেড়িবাধ উদ্যোগে প্রধান কারন।দূর্যোগে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লেই বার বার বেড়িবাধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় লোকালয়ে। বিশেষ করে লবন পানি ঢুকে বিপর্যস্ত হয় জনজীবন। নষ্ট হয়ে যায় খাবার পানির উৎসসহ সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকান্ড। এছাড়া উককূলে বসবাসরত বিপুল সংখ্যাক মানুষের জন্য নেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এ বিষয়ে গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল দেশচিত্র প্রতিবেদককে কথা হলে তিনি বলেন, গাবুরা ইউনিয়নে বাসিন্দা প্রায় ৪৫ হাজার অথচ এখানে সাইক্লোন শেল্টার আছে মাত্র ১৫টি। এত মানুষকে এ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া স্কুল, মাদরাসাসহ বিভিন্ন পাকা ভবনে অল্প কিছু মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। এত মানুষকে এ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, ঝড়ের চেয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় ভয় বেড়িবাঁধ নিয়ে। আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ কোনো রকমে টিকে আছে। নদীর পানি বাড়লেই বিভিন্ন অংশে ভাঙন তৈরি হতে পারে। সরকার নতুন করে এখানে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেও কাজ শুরু হয়নি।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের দেশচিত্র কে বলেন, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। বাকি জায়গাগুলো পর্যায়ক্রমে সংস্কার হবে।
তিনি আরও বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের আওতায় সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৭০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৩৫টি পয়েন্টর প্রায় ২০০ কিলোমিটার।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন দেশচিত্রকে বলেন, আগের কয়েকটি দুর্যোগে অগ্রিম প্রস্তুতি থাকায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেছে। এবারো আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১০৩টি। এছাড়া স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ অন্য পাকা ভবনে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১৮০টি। এসব কেন্দ্রে প্রায় এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। তবে এ উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ুন করিব দেশচিত্রকে বলেন, এরই মধ্যে উপকূলীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় জেলায় সাইক্লোন শেল্টারের সংখ্যা অনেক কম। আগামীতে নতুন করে আরও কিছু সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি গাবুরা ইউনিয়নের চারপাশে নতুন করে টেকসই বাঁধ নির্মাণে এক হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে টেন্ডার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি চলতি বছর নতুন বাঁধের কাজ শুরু হবে বলে জানান।
© Deshchitro 2024