|
Date: 2024-01-30 12:09:29 |
গত ১৯ ও ২০ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রী: দুইদিন ব্যাপী শহীদ সুভাষ হলে মঞ্চস্থ হলো জেলা শিল্পকলা একাডেমী, কক্সবাজার রেপার্টরি নাট্যদলের প্রযোজনায় এবং ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এর রচনায় ও স্বপন ভট্টাচার্য এর সম্পাদনা ও নির্দেশনায় নাটক “আলীবাবা”। নাটকের নাম শুনতেই মনে পড়ে গেল ছোট বেলার বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশনে বহুল প্রচারিত ধারাবাহিক আরব্য রজনীর কাহিনী বা গল্প তথা ‘আলিফ লায়লা’ যার অন্যতম সাড়া জাগানো লোককাহিনী হলো ‘আলীবাবা ও চল্লিশ চোর।’রাত আট টা বাজলেই রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে মুদি দোকান দার, ছোট থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ সহ সকলেই কাজ কর্ম শেষ করে টিভি পর্দার সামনে জড়ো হতো। গ্রাম থেকে শহরে প্রতিটি পাড়া মহল্লার চায়ের দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভীড় থাকতো। চা আড্ডা আর ‘আলিফ লায়লা’ সমানতালে উপভোগ করতো সকল শ্রেণীর দর্শক যা আজো আমাদের মগজ ও মননে গেঁথে আছে। ১৯০৩ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত নির্দেশক হীরালাল সেন ‘আলী বাবা ও চল্লিশ চোর’ নামে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।১৯৪৩ সালে ‘Alibaba and The Forty Thieves’ নামেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ২০১৪ সালে সৃষ্টি কালচারাল সেন্টার এর প্রযোজনায় আলীবাবা গল্পকে কেন্দ্র করে নৃত্যনাট্য ‘বাঁদী-বান্দার রূপকথা’ মঞ্চায়ন হয়। বাংলাদেশে খুব সম্ভবত ১৯৭৯ সালে আজিজুর রহমান তার পরিচালনায় “আলীবাবা ও চল্লিশ চোর” নামে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।দীর্ঘ সময় পর একই বিষয় বা গল্পকে উপজীব্য করে কক্সবাজারে মঞ্চায়ন হলো নাটক “আলীবাবা।”
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি অনুবাদক আঁতোঁয়া গালাঁ সিরীয় লোককথক হান্না দিয়াবের কাছে গল্পটি শুনে এটিকে আরব্য রজনী এর কাহিনীমালায় যুক্ত করেন। আরব্য রজনীর গল্পগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় হলো ‘আলীবাবা ও চল্লিশ চোর’। প্রদর্শনীর প্রথম দিন ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকায় একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দ্বিতীয় দিন নাটকটি দেখতে গিয়েছিলাম।নাটকের সেট দেখে নিজের চোখের উপরই অবিশ্বাস চলে আসলো। পুরো মঞ্চ জুড়ে নাটকের সেট দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একটু আগে থেকেই দর্শক সারিতে আসন গ্রহণ করে অপেক্ষায় রইলাম নাটক শুরুর। সন্ধ্যা ৭.৩০ টায় নাটক শুরু করার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে নাটক শুরু করতে সন্ধ্যা ৭.৩৪টা পেরিয়ে যায়। মানুষের অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকে, সাথে বাড়তে থাকে দর্শকের সংখ্যা। ছোট পরিসরে নাট্য নির্দেশক শ্রোতাদের অভিবাদন জানিয়ে শুরু করেন নাটক।চমৎকার আবহসঙ্গীতের সাথে দৃশ্যায়নের অপূর্ব সংমিশ্রণের মধ্যদিয়ে নানা ঘটনা প্রবাহে এগিয়ে চলছে নাটক।সাধারণ দর্শক হিসেবে শুধুই নিরবে উপভোগ করলাম।যাই হোক, এবার একটু নাটকের গভীরে প্রবেশ করি। প্রথমেই আসা যাক নাটকের গল্প ও পটকথায়। গল্পের সার সংক্ষেপ হলো – এক বণিক পরিবারের দুই ভাই কাশিম ও আলীবাবা। কাশিম ছিল লোভী প্রকৃতির ও অনেক ধন – সম্পদের মালিক। আর আলীবাবা ছিল একজন দরিদ্র ও সৎ কাঠুরিয়া। যে কাঠ কেটে বিক্রি করে সংসার নির্বাহ করে। বনে কাঠ কাটতে গিয়ে একদিন আলীবাবা চোরদের গুপ্ত আস্তানার সন্ধান পায় এবং সেখানে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জাদুশব্দ শুনতে পায়। চোরদল আস্তানা থেকে চলে যাওয়ার পর আলীবাবা সেই জাদুশব্দে গুহায় প্রবেশ করে অনেক হিরা- মণি মুক্তার সন্ধান পায় এবং বস্তায় পুরে নিজের ঘরে নিয়ে আসে এবং বিষয়টি তার স্ত্রী ফাতিমা ও ছেলে হুসেনকে অবগত করলেও ধনের উৎস কাউকে না জানাতে বলে। ফাতিমা মণি-মুক্তা মাপার জন্য কাশিমের বাড়িতে ধান মাপার কথা বলে কুনকে চাইলে কাশিমের চতুর স্ত্রী সাকিনা কুনকের তলায় আঠা লাগিয়ে দেয়। ফেরত দেয়া কুনকের তলায় সোনার মোহর লেগে থাকায় সাকিনার সন্দেহ হয় এবং বিষয়টি তার স্বামী কাশিমকে জানায়।কাশিম আলীবাবার ঘরে গিয়ে মর্জিনাকে বিক্রি করে দেয়ার হুমকি দিয়ে গুপ্তধনের উৎস জানতে চাইলে, মর্জিনাকে রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে আলীবাবা সব বলে দেয় এবং গুহায় প্রবেশ-বাহিরের জাদুশব্দ শিখিয়ে দেয়।কাশিম লোভ সামলাতে না পেরে জাদুমন্ত্রে গুহায় প্রবেশ করে রাশি রাশি গুপ্তধন দেখে পাগল হয়ে যায় এবং গুহা থেকে বের হওয়ার মন্ত্র ভুলে যায়। এমন সময় চোরদল গুহায় প্রবেশ করে কাশিমকে দেখতে পেয়ে হত্যা করে চার টুকরা করে ঝুলিয়ে রেখে চলে যায়। আলীবাবা গুহা থেকে কাশিমের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে এবং মর্জিনার বুদ্ধিমত্তায় বৃদ্ধ জুতা সেলাইকারী বা মুচি বাবা মুস্তফার সহযোগিতায় লাশের চার টুকরা সেলাইয়ের মাধ্যমে এক দেহ করে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে জনমনে প্রকাশ করে। এদিকে গুহায় কাশিমের লাশ না পেয়ে চোরদল বুঝতে পারে তৃতীয় কোন ব্যক্তি তাদের গোপন আস্তানা ও গুপ্ত ধনের কথা জানে। তার হন্যে হয়ে সেই ব্যক্তিকে হত্যার জন্য খুঁজতে থাকে। অবশেষে জুতা সেলাইকারী বৃদ্ধ বাবা মুস্তফার বদৌলতে চোরদল আলীবাবার সন্ধান পায় এবং তারা আলীকে হত্যার পরিকল্পনা সরূপ চোরের সর্দার ৪০ টি তেলের পিপা নিয়ে আলীর ঘরে রাতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ৪০টি পিপার মধ্যে ০১ টি পিপায় তেল ও বাকি ৩৯টি পিপায় চোর ছিল। আলীবাবা রাতে ঘুমিয়ে পড়লে, মর্জিনা ও আবদালা চোরদের পরিকল্পনা টের পেয়ে, ৩৯টি পিপায় গরম তেল ঢেলে তাদের হত্যা করে। পুনরায় হত্যার উদ্দেশ্যে চোর সর্দার আলীবাবার ছেলে হোসেনের বন্ধু সেজে দরবেশ হয়ে তাদের ঘরে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। এবারও মর্জিনা দরবেশের পরিকল্পনা বুঝতে পারে এবং নাচ দেখানোর ছুঁতায় সর্দারের বুকে ছুঁড়ি মেরে তাকে হত্যা করে আলীবাবাকে প্রাণে বাঁচায়। কৃতজ্ঞতাবশে আলীবাবা তার ছেলে ও মর্জিনার বিয়ে দেয়। এই হলো নাটকের মূল বিষয় বস্তু।
আগেই বলেছি নাটকটি অষ্টাদশ শতকের এবং সেই সময়ের প্রকৃত বিষয়বস্তু বর্তমান প্রজন্মের গ্রহণোপযোগী করার ক্ষেত্রে নির্দেশক যথেষ্ট শ্রম, মেধা ও সময় ব্যবহারে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং সেই সময়ের গল্পের ঘটনাগুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে একই সূঁতায় গাঁথার চেষ্টায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নাটকের দৃশ্যায়নগুলো করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি চরিত্রকে তার সুনিপুণ তুলির আঁচড়ে এমনভাবে এঁকেছেন, মনে হচ্ছে প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত।
আরব্য রজনীর কাহিনী বা গল্পকে দুই-এক ঘন্টার নাটকে উপস্থাপন করা রীতিমতো দুরূহ কাজ। আর নির্দেশক ও তার দল সেই দুরূহ কাজটি সুচারুভাবে করার চেষ্টা করেছেন।এর মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রজন্ম নতুন করে লোককাহিনী সম্পর্কে জানার সুযোগ ও অনুপ্রেরণা পেয়েছে।
দৃশ্যায়ন ও সম্পাদনা ঃ এবার দৃষ্টিপাত করি নাটকের দৃশ্যায়ন বা দৃশ্য সংযোজন নিয়ে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকে দৃশ্য সংযোজন বেশ ভালো ছিল এবং কিছু কিছু দৃশ্য বেশ গতিময় ছিল। তবে নাটক কিছুটা স্লো পেইজে বা ধীর গতিতে এগিয়েছে।শেষের দিকে বিশেষ করে নাটকের ক্লাইমেক্স এর আগের দুই একটা দৃশ্য দেখে মনে হলো নাটকের লাইন বা ধারাবাহিকতা ভেঙ্গে হঠাৎ করে চলে এসেছে। যেমন : কাশিমের গুহায় প্রবেশ, তার শোকে স্ত্রীর কান্না বা আলীর সন্ধান জানার জন্য মুচির সাথে চোরের স্বাক্ষাত দৃশ্যগুলো সম্ভবত নাটকের ব্যাপ্তি মাথায় রেখে নাট্যকার কিছুটা কাটসাট করেছেন।যাই হোক, ভবিষ্যতে নির্দেশক সম্পাদনায় আরো একটু মনোযোগ দিলে নাটকে আরো প্রাণ সঞ্চারিত হবে ও নাটকের ধারাবাহিকতাও বজায় থাকবে বলে মনে করি। তবে নিঃসন্দেহে নাটকের সেরা দৃশ্য ৪০টি তেল পিপার ৩৯টি তে চোরদের লুকিয়ে থাকার দৃশ্য, যেখানে চোর সর্দারের ইশারায় ৩য় চোর রাজীব দেবদাশ এর ‘জ্বি সর্দার’ বলে মাথা তুলে দেখা। দৃশ্যটি এতই সময়পূর্ণ হয়েছে, ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। দুইটি শব্দের ‘জ্বি সর্দার’ একটি সংলাপ কতো কতো ওজনদার, ভারী ও মাহাত্ম্যপূর্ণ হতে পারে এবং তা নাটকে কতো গুরুত্ব বহণ করেছে বর্ণনাতীত, কেবলই অনুভব করার বিষয়। পাশাপশি ফাতিমার পেটে পীড়া হওয়ার দৃশ্য ছিল বেশ মজাদার ও নাটকীয়। হুসেন ও মর্জিনার একান্ত কথোপকথনের সময় হুসেন তার মনের ভাব প্রকাশে তোতলিয়ে সংলাপ প্রক্ষেপণ রোমান্টিসিজম তৈরি করেছে।তবে পুরো নাটকের প্রাণ ছিল চোরদল। তারা যখনই মঞ্চে প্রবেশ করেছে সাথে সাথে নাটকের গতিও বেড়েছে।
চরিত্রায়নঃ চরিত্র নির্ধারণে নির্দেশক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কক্সবাজারের পরিক্ষিত কয়েকজন সংস্কৃতি কর্মীদের কাজে লাগিয়ে তাদের থেকে প্রত্যাশিত কাজ আদায় করে নেয়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল বলা যায়। প্রতিটি চরিত্রের মেরিট বা ওজন বুঝে তৎমাফিক যোগ্য শিল্পী বাছাই করে তাকে দিয়ে চরিত্রায়ন করানোয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন নির্দেশক। প্রতিটি চরিত্র স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাবলীল ছিল। বিশেষ কয়েকটি চরিত্রের কথা বলতেই হয়। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র আলীবাবা চরিত্রে সুশান্ত পাল বাচ্চু ভালো অভিনয় করলেও দুই একটি দৃশ্যে একই সংলাপ বার বার আওড়ানোতে সংলাপ ভুলে যাওয়া লক্ষনীয় ছিল, ফাতিমা চরিত্রে ফাল্গুনী দাশ চমৎকার ছিল, বিশেষ করে আলীবাবা গুপ্তধন আনার পর তালগোল পাকানো আত্মভোলা কথোপকথনের দৃশ্য ছিল অসাধারণ, কাশিম চরিত্রে সায়ন্তন ভট্টাচার্য ছিল সাবলীল, সাকিনা চরিত্রে বনানী চক্রবর্তী খুব ভালো করেছে, গৃহ পরিচারিকা মর্জিনা চরিত্রে শাহানা মজুমদার চুমকি ভালো অভিনয় করেছে তবে বডি মুভমেন্ট আরেকটু ফ্লেক্সিবল হলে চরিত্রটি আরো গতি পেত বলে মনে হয়, বিশেষ করে গানের সাথে নাচ করার সময় মুজরার ব্যবহার এবং যন্ত্রাংশের সুর মিলিয়ে সরাসরি গান করার সময় দূর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে, আবদালা চরিত্রে প্রবালের অভিনয়
প্রশংসনীয়, বিশেষ করে মর্জিনার সাথে গানের তালে তালে তার নাচ দর্শকদের বিনোদিত করেছে তবে অভিনয়ে আরেকটু নিয়ন্ত্রিত হতে পারলে আরো ভালো করবে, আলীবাবার ছেলে হাবা গোবা হুসেন চরিত্রে আসিফ সাইফুল আবীর ছিল একদম মানানসই। তার মুখশ্রী চরিত্রের গভীরে প্রবেশে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে।বৃদ্ধ মুচি বাবা মুস্তফা চরিত্রে সত্যপ্রিয় চৌধুরী দোলন ভালো অভিনয় করেছে তবে মাইক্রোফোন থেকে দূরে থাকায় তার প্রক্ষেপিত কিছু সংলাপ দর্শকদের বুঝতে সমস্যা হয়েছে। তবে পুরো নাটক মাতিয়ে রেখেছে চোরেরদল- আবছার, মনির মোবারক, সরূপ চক্রবর্তী, হাশেম ও রাজীব দেবদাশ। তারা যখনই মঞ্চে প্রবেশ করেছে, মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছে, বাদি-১ চরিত্রে তুহি ও বাদি-২ চরিত্রে চন্দ্রিমা ছিল স্বাভাবিক। নাটকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ প্রতিবেশি চরিত্রে স্বপ্না চক্রবর্তী। স্বল্প সময়ের মঞ্চ উপস্থিতিতে তার স্পষ্ট ও প্রমিত উচ্চারণের সাথে অভিনয়ের সাবলীলতা মনে দাগ কেটেছে। নাট্য নির্দেশক নিঃসন্দেহ এমন ব্যক্তিত্বকে দীর্ঘ সময় পর পুনরায় মঞ্চে ফিরিয়ে আনার জন্য আলাদাভাবে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
পোশাক ও রূপসজ্জা ঃ নাটকের পান্ডুলিপির চাহিদা মোতাবেক তথা সময়, স্থান, চরিত্র, বয়স ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে নাটকের পোশাক অসাধারণ ছিল। পোশাকের দরুণ প্রতিটি চরিত্রের স্বকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে। চোরদের পোশাক ও রূপসজ্জা, কাশিম-সাকিনা,আলীবাবা-ফাতিমা, মর্জিনা-আবদালার পোশাক ছিল দৃষ্টিনন্দন। পাশাপাশি প্রতিটি চরিত্রে বয়স, কর্ম, আত্ম-সামজিক অবস্থান বিবেচনায় তাদের রূপসজ্জা প্রত্যেক চরিত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্যতিক্রম রূপসজ্জায় আবদালা সবার নজর কেড়েছে।
সেট ডিজাইন ও আলোক পরিকল্পনাঃ একই মঞ্চে পর্বত, গুহা, বন ও প্রাসাদ এর ভিন্ন ভিন্ন সেট, তার সাথে লাইটের আলো আধারি খেলা দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। জাদুশব্দে গুহার দরজা খোলা ও বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া দর্শককে আনন্দ দিয়েছে।
সঙ্গীত ও আবহ সঙ্গীতঃ সংগীত ও আবহ সঙ্গীত যেকোন নাটকের জন্য গুরুত্ব বহন করে এবং একটা ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। আবহ সঙ্গীত এই নাটকের প্রাণ বলা যায়। নাটকের পাণ্ডুলিপির চাহিদা অনুযায়ী সঙ্গীতের যথার্থ ব্যবহার শক্তিশালী ভীত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু বিশেষ মুহুর্তের কথা না বললেই নয়। বিশেষ করে নাটকের শুরু থেকে প্রতিটি দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে বাজতে থাকা আবহ সঙ্গীত, চোরদের প্রবেশের সময় ঘোড়ার ছুটে চলার শব্দ ও ঘোড়ার ডাক এবং নাটকের ক্লাইমেক্সে যে আবহ সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে, তা দর্শকের মন ছুঁয়ে গেছে। প্রতিটি মুহুর্তে দর্শক স্মৃতিতে অনুভব করেছে। নাটকে গানগুলো ভালো ছিল যদিও গায়কিতে সমস্যা ছিল, তবু গান নাটক ঝুলে যাওয়ার গতি কিছুটা হলেও রোধ করতে পেরেছে।পাশ্চাত্যের ধাঁচে এই আবহ সঙ্গীত নাটককে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।
অসংগতি ঃ বড় কাজে কিছু অসংগতি বা ঘাটতি থাকবেই। এই নাটকেও ছিল…..
# পুরো মঞ্চজুড়ে নাটকের সেট থাকায় এবং ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে নাটকের সংলাপ প্রক্ষেপণ দর্শক ঠিক মতো গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষ করে অভিনয় শিল্পীদের মাইক্রোফোনের সাথে সামন্জ্ঞস্যপূর্ণ না হওয়ার কারণে।
# চোরদের গোপন আস্তানা খোলার জাদুশব্দ ‘চিচিং ফাঁক’ উচ্চারণ বেশ কানে লেগেছে।
# কোন কোন ক্ষেত্রে অভিনয় শিল্পী সংলাপ দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু আলো পায়নি বা লাইট পড়েনি।
# কিছু দৃশ্যে অভিনয় শিল্পীদের জেস্চার-পোস্চার ও সংলাপ প্রক্ষেপণে ক্লান্তির ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। সম্ভবত আগের দিন প্রদর্শনী থাকায় তারা কিছুটা ক্লান্ত।
# কোরাসের দূর্বলতা পরিলক্ষিত
# নির্দেশক স্বপন ভট্টাচার্য এর নাটক মানে জমজমাট কোরিওগ্রাফি ও মঞ্চে ঝলমলে আলোর খেলা দেখতে দর্শক অভ্যস্ত। কিন্তু এবার তিনি সে পথে না হেঁটে পান্ডুলিপির চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে দুই-একটি দলীয় কোরিওগ্রাফি সংযোজন করতে পারতেন বলে মনে হয় এবং এতে করে নাটক আরো বেশি গতিময় হতো।
সম্পাদনা ও নির্দেশনাঃ সবশেষে আসি তার কথায়, যার অক্লান্ত শ্রম, মেধা, সময়, শৈল্পিক ও মননশীল চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এই মহৎ কাজে। এতো বড় পরিসরে কাজ কেবল তাঁকে দিয়েই সম্ভব। দীর্ঘ একটি কাহিনীকে তিনি সুনিপুণ হাতের তুলির আঁচড়ে প্রতিটি দৃশ্য ও চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন সংগঠনের সংস্কৃতি কর্মীদের সাথে নিয়ে নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে নাটকটি উপস্থাপন করতে তাকে নিশ্চয় অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং সকল বাধাঁ বিপত্তি মোকাবেলা করে শেষ পর্যন্ত নাটক মঞ্চে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ । সে চ্যালেঞ্জে তিনি সফল। পাশ্চাত্যের আদলে লোককাহিনী সর্বস্ব “আলীবাবা” আমাদের সমাজ বদলের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। কাশিমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লোভে পাপ পাপে মৃত্যু, সৃষ্টকর্তা ও নিজ কর্মের প্রতি বিশ্বাসের দরুণ সততার পুরুষ্কার, চোর সর্দারের মৃত্যুর ফলে অন্যায়কারীর পরাজয়, মর্জিনা-হুসেন এর বিবাহ শ্রেণি বৈষম্য ভাঙ্গা, কাশিমের অপরাধ ক্ষমা করে আলীবাবা যে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা অতুলনীয়। এক কথায় “আলীবাবা” শোসকের বিরুদ্ধে শোষিতের জয়গাঁথা। সর্বোপরি নির্দেশক এই নাটকের মাধ্যমে দর্শকদের ক্ষমা, ঔদার্য, পরোপকার, সততা ও নৈতিক চরিত্রের শিক্ষাদানের স্বার্থকতায় পরিপূর্ণ।তার এই সফলতার সিঁড়ি তার হাসির মতো ক্রমশ বিস্তৃত হোক এই প্রত্যয় ব্যক্ত করি। এতোক্ষণ পর্যন্ত যার কৃত কর্মের উপর কথা বলার দুঃসাহস করলাম তিনি আর কেউ নন আমাদের সবার প্রিয় বিশিষ্ট নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক স্বপন ভট্টাচার্য।
© Deshchitro 2024