এক.

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭কোটি। দেশের আয়তনের তুলনায় এ জনসংখ্যা অনেক বেশি।  পক্ষান্তরে স্বাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বিআইডিএসের গবেষক শহিদুল্লার মতে, বিশাল এ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বিপরীতে সরকারি চাকরি মাত্র ২%, এছাড়াও সরকারি চাকরির প্রতি শিক্ষিত বেকারদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।  ফলে যেকোনো সরকারি চাকরির নিয়োগে দেখা যায় প্রতি একটা পদের জন্য নুন্যতম ১০০ জন আবেদন করে, এটা অনুমান নির্ভর। তবে, ১২ই জুন ২২ এর জাতীয় দৈনিক 'প্রথম আলোর' একটা প্রতিবেদনের সূত্রে জানা যায়, " কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে ৫০৬টি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ২ লাখ ৫৫ হাজার ২৯২ জন। অর্থাৎ প্রতি একটা পদের জন্য ৫০৪ জনেরও বেশি! তাহলে দেখে নেওয়া যাক, সে ৫০৬ টি পদের পরীক্ষায় আবেদন ফি হিসেবে সরকারের কত টাকা আয় হয়েছে। কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদটি ১৬ তম গ্রেড, যার আবেদন ফি তখন ছিলো ১০০ টাকা। সুতরাং ২লাখ ৫৫ হাজার ২৯২ এর একশো গুন সমান ২ কোটি ৫৫ লক্ষ ২৯ হাজার ২০০ টাকা! অবাক হচ্ছেন? আপনি আরো অবাক হবেন, সে নিয়োগটি বিভিন্ন পদে মোট ১৩৫৭ টি শূন্য পদের পরীক্ষা হয়। সুতরাং বিভিন্ন পদ ও আবেদনকারীর সংখ্যা এবং ফি বিবেচনায় কল্পনা করুন,  সে আয়ের সর্বমোট টাকার অংকটা কত বড়ো হতে পারে! 

দুই.
আমাদের দেশে প্রায় সময় ছাত্র/ছাত্রী কিংবা চাকরি প্রত্যাশিরা এই আবেদন ফি-টা বাদ দেওয়ার জন্য, বিভিন্নভাবে অগোছালো আন্দোলন ও বাদ-প্রতিবাদ করেছিলো। কিন্তু সরকার সেই ফি বাদ করেনি, বরং আরো দ্বিগুণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করলো। গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর অর্থ-বিভাগ, প্রবিধি-২ অধিশাখার জারিকৃত, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোছা. নারগিস মুরশিদার সই করা ২২ সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখের ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ৯ম গ্রেড বা এর বেশি গ্রেডভুক্ত (নন–ক্যাডার) পদে আবেদন ফি ৬০০ টাকা করা হয়েছে। এই ফি আগে ছিল ৫০০ টাকা। ১০ম গ্রেডে ফি ৫০০ টাকা অপরিবর্তিত রয়েছে। ১১তম এবং ১২তম গ্রেডেও পরীক্ষা ফি ৩০০ টাকা অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ১৩তম থেকে ১৬তম গ্রেডে ১০০ টাকা থেকে দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০০ টাকা করা হয়েছে। ১৭তম থেকে ২০তম গ্রেডেও ফি দ্বিগুণ হয়েছে। এই তিন গ্রেডে ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা হয়েছে।

তিন.
আবেদন ফি বাদ দেওয়ার পরিবর্তে সরকার কেন আবেদন ফি বাড়িয়ে দিলো, এ বৃদ্ধির বিষয়টি কতটা যুক্তিক তা খতিয়ে দেখাও সময়ের দাবি। সরকার কিংবা মন্ত্রণালয় হয়তো,  বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম বৃদ্ধিকেই উত্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। তবুও বলা যায়, এ যুক্তি ধূপে টিকবে না! কেননা, সে বিষয়ে উপরে উল্লিখিত নিয়ো বিজ্ঞপ্তির হিসাবটার ব্যয়ের খাত সামনে তুলে ধরলেই বুঝতে পারবেন। এখানে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আয় আবেদনের ভিত্তিতে এবং ব্যয়ের চিত্র দেখানো হবে অনুমান নির্ভর।  আমরা দেখেছি, ৫০৬ টি পদের জন্য ২ লাখ ৫৫ হাজার ২৯২ চাকরি প্রার্থী সরকারকে দিয়েছে, ২ কোটি ৫৫ লাখ ২৯ হাজার ২০০ টাকা। সরকার তাদের লিখিত পরীক্ষার জন্য পরীক্ষার্থীর সমান সংখ্যা প্রশ্ন ছাপাতে খরচ হয়েছে, ২৫৫২৯২ টাকা, লিখিত পরীক্ষার খাতা প্রস্তুত করতে খরচ হয়েছে, জন প্রতি ৫ টাকা হলেও, ২৫৫২৯২×৫ সমান ১২৭৬৪৬০ টাকা। যারা পরীক্ষা নেয় তাদের সম্মানি হিসেবে ( ২৫৫২৯২÷৫০=৫১০৫×১০০০) ২৫৫২৫০০ টাকা। মৌখিক পরীক্ষার জন্য ৫০ জন পরীক্ষকের জন্য ৫০×৩০০০= ১৫০০০০ টাকা এবং অন্যান্য ১০০০০০০ টাকা যদিও হয়, সব মিলিয়ে সর্বমোট খরচ হবে (  ২৫৫২৯২+১২৭৬৪৬০+২৫৫২৫০০+১৫০০০০+১০০০০০০) ৫২৩৪২৫২ টাকা! তাহলে, সরকারের আয় হলো ( ২৫৫২৯২০০-৫২৩৪২৫২) ২০২৯৪৯৪৮ টাকা। যদি ধরে নিই, সরকার তৃতীয় কোনো পক্ষকে ১ কোটি টাকা বরাদ্দের মাধ্যমে পরীক্ষা নিলো, তারপরও সরকারের লাভ ১৫৫২৯২০০ টাকা! 

চার.
একটা নির্বাচিত সরকার যা ইচ্ছে তা করতে পারবে; কমপক্ষে সরকার গঠনের দিন থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর।  তবে, সরকারকে এটাও মনে রাখতে হবে, টিকে থাকতে হলে এবং পরবর্তীতে আবার ক্ষমতায় আসার ইচ্ছে থাকলে, তার দেশের জনমতকে প্রাধান্য দিতে হবে। আর, এ জনমতের তুরুপের তাস হলো আমাদের ছাত্র ও শিক্ষিত বেকার যুব সমাজ। আপনি যদি তাদেরকেও বিভিন্ন উপায়ে শাসন শোষণের চিন্তা করেন, একদিন তারাও আপনার গণেশ উল্টিয়ে দিবে। পরিশেষে, সরকারের উদ্দেশ্যে একটা কথায় বলবো, বর্ধিত আবেদন ফি বাতিল এবং পূর্বের ফি কমানোর পাশাপাশি,  যেকোনো নিয়োগের বিপরীতে আবেদনকারী সংখ্যা যদি বিভাগ ভিত্তিক ৫০ হাজারের বেশি হয় কিংবা কোনো নিয়োগের শূন্য পদের সংখ্যা যদি এক হাজারের অধিক হয়, সেক্ষেত্রে বিসিএস কিংবা প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার মতো বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।  আপনারা হয়তো,  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখে আবেদন ফি বাড়ানোকে যুক্তিক মনে করেছেন কিন্তু এ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দিনে একজন ছাত্র কিংবা বেকার শিক্ষিত যুবক কীভাবে এবং কোথা হতে বর্ধিত আবেদন ফি কিংবা ঢাকায় আসা-যাওয়া এবং থাকা-খাওয়ার ব্যয় বহন করবে সেই চিন্তা করেননি। রেকেল অল্কিন  বলেছেন, " আমরা কিভাবে ভুল করি তা নয়, আমরা কিভাবে ভুল সংশোধন করি তা আমাদের সংজ্ঞায়ন করে। " সুতরাং নিজেদের ভুলকে স্বীকার করুন,  সংশোধন করুন, সংজ্ঞায়ন করুন।



আসহাবে কাহাফ
প্রাবন্ধিক



প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024