◾মো. সৈয়দুর রহমান


এদেশে বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এর আগেও ছিল কিন্তু তুলনামূলক কম। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ এমনকি মাদ্রাসা ও মেডিকেলের শিক্ষার্থীরাও তুচ্ছ কারণে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। বিশেষজ্ঞরা আত্মহত্যার কারণ হিসেবে পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, প্রেমে ব্যর্থতা, বেকারত্ব, নিঃসঙ্গতা, স্বপ্নপূরণের পথ খুঁজে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ ও অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতাকে দায়ী করছেন। এছাড়া করোনাকালীন সময়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় আত্মহত্যার এ হার আরও বেড়ে গিয়েছে। 


বর্তমানে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত থাকে। কোনো কারণে ফলাফল বিপর্যয় ঘটলে তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। একইসাথে পারিবারিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও চাপের কারণে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছাত্রছাত্রীরা। তাই প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরই দেখা যায়, প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জিত না হওয়ায় আত্মহননের পথ বেছে নিতে দ্বিধা করে না অনেকেই। শিক্ষাবিদদের মতে, ফল নিয়ে অতিরিক্ত হইচই এবং জ্ঞানার্জনকে চরম প্রতিযোগিতামূলক করে তোলায় হতাশা বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ ব্যবহারের ফলে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা জড়িয়ে পড়ছে প্রেমের সম্পর্কে। বেসরকারি একটি গবেষণার প্রতিবেদনে দেখা যায়, সম্পর্কগত বিচ্ছেদের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। যা সত্যি চরম হতাশাজনক।


আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পিছনে নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করছে জেনারেশন গ্যাপ। অর্থাৎ, সন্তানরা তাদের ব্যক্তিগত কথা বা অনুভূতি পরিবারের কাছে বিশেষ করে অভিভাবকদের কাছে খুলে বলতে পারে না। অনেকসময় পিতা-মাতা সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে না পারায় তারা নিঃসঙ্গতায় ভোগে। ফলস্বরূপ, সন্তান এবং পিতা-মাতা একে অপরের বন্ধু না হয়ে প্রতিপক্ষ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পারিবারিক কলহ শিক্ষার্থীদের মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেউই নজর রাখেন না। সামাজিক ও পারিবারিক নানা কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। গবেষণায় প্রমাণিত যে মানসিক অসুস্থতা, বিশেষ করে বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্ব ও আবেগের সমস্যা, মাদকাসক্তি আর সিজোফ্রেনিয়ায় যাঁরা ভুগছেন; তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে অপসংস্কৃতির সংস্পর্শে এবং হিরোইজম দেখানোর জন্যও এরা চলে যায় বিপথে এবং এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা প্রচারমাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদের অতিপ্রচার বা অপপ্রচার করা হয়। যা দেখে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এর প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ে। কানাডাভিত্তিক একটি সংস্থার গবেষণায় দেখানো হয়, গণমাধ্যমে তারকাদের আত্মহত্যার খবর এবং তাঁরা কীভাবে আত্মহত্যা করেছেন, এর বিস্তারিত বর্ণনা আত্মহত্যা সংক্রমিত করেছে।


মোটকথা, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই শিক্ষার্থীদের একটি সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আলাদা নজর রাখার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পরিবারে সন্তানদের বেশি বেশি সময় দিয়ে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিৎ যাতে তারা যেকোনো কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারে। শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে। কারো আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দিলে দ্রুত তার সঠিক কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া সামাজিকভাবে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেন কেউ হতাশাগ্রস্ত হলে তার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ না করে তার পাশে দাড়ায় সবাই। সঠিক উপায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে সকলে নজর দিতে পারলেই ক্রমবর্ধমান এ আত্মহত্যার হার অনেকটা কমে আসবে বলে প্রত্যাশা রাখি। 



◾মো. সৈয়দুর রহমান

লেখক ও শিক্ষার্থী



প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024